গত ২৭/০৫/২০২০ খ্রি. জনাব মোঃ শফিকুল ইসলাম (২৮) পিতা-মোঃ আমজাদ আলী, সাং-হোচরবালা, থানা-ভুরুঙ্গামারী, জেলা-কুড়িগ্রাম মাহিগঞ্জ থানায় হাজির হইয়া লিখিতভাবে অভিযোগ করেন যে, গত ইং ০৬/০৫/২০২০ তারিখ রাত্রী অনুমান ১১.৫০ ঘটিকার সময় অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি তাহার মোবাইল নম্বর হইতে অভিযোগকারী জনাব মোঃ শফিকুল ইসলাম এর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে ফোন করিয়া বিভিন্ন প্রকার ইসলামীক কথা বলিয়া তাহার ভাগ্য পরিবর্তন হইবে মর্মে আশ্বাস প্রদান করিয়া তাহার নিকট হইতে ধাপে ধাপে সর্বমোট ১,০৮,৫০০/-টাকা গ্রহন করেন। এই সংক্রান্তে মাহিগঞ্জ থানার মামলা নং-০৮, তারিখ-২৭/০৫/২০২০ খ্রিঃ, ধারা-৪০৬/৪২০/১০৯ পেনাল কোড তৎসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ৩০(১)(ক) রুজু করা হয়।
মামলাটি রুজু হওয়ার পর মাননীয় পুলিশ কমিশনার জনাব মোঃ আবদুল আলীম মাহমুদ বিপিএম মহোদয়ের নির্দেশনায় এবং উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) জনাব কাজী মুত্তাকী ইবনু মিনান মহোদয়ের সার্বিক তত্বাবধায়নে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জনাব মোঃ শহিদুল্লাহ কাওছার পিপিএম, সহকারী পুলিশ কমিশনার জনাব মোঃ ফারুক আহমেদ, অফিসার ইনচার্জ জনাব মোঃ আখতারুজ্জামান প্রধান, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) জনাব মোঃ শাহআলম সরদার মামলার বিষয়ে কাজ শুরু করেন। মামলাটির প্রকৃত রহস্য উম্মোচন ও জড়িত অপরাধীদের সনাক্তপূর্বক আইনের আওতায় আনার লক্ষ্যে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দিক নির্দেশনায় সহকারী পুলিশ কমিশনার (মাহিগঞ্জ জোন) জনাব মোঃ ফারুক আহমেদ বিভিন্ন আঙ্গিকে নানা উৎস থেকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ শুরু করেন। প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিতকরণে ব্যাপক গোয়েন্দা কার্যক্রম চালানো হয়। সংগৃহীত তথ্য উপাত্ত যাচাই বাছাই করে প্রকৃত অপরাধীদের সনাক্ত করা হয়।
পরবর্তীতে ইং ২৮/০৫/২০২০ খ্রি. সহকারী পুলিশ কমিশনার (মাহিগঞ্জ জোন) জনাব মোঃ ফারুক আহমেদ এর নেতৃত্বে পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) জনাব মোঃ শাহআলম সরদার, এসআই(নিরস্ত্র)/মোঃ মাজহারুল ইসলাম, এসআই(নিরস্ত্র)/মোঃ আব্দুল আলীম, এসআই(নিরস্ত্র)/মোঃ নুর আমিন, এএসআই(নিরস্ত্র)/মোঃ পেয়ারুল ইসলাম সঙ্গীয় ফোর্সসহ গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থানাসহ বিভিন্ন স্থানে দিনরাত ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করিয়া মামলার মুলহোতা ১। মোঃ রিয়াদ হাসান রকি @ রায়হান (২০) পিতা-মোঃ আঃ করিম ২। মোঃ সিদ্দিকুল ইসলাম (৩৫) পিতা-মৃতঃ আফছার আলী, উভয়সাং-তালুক কানুপুর ৩। মোঃ আজহার আলী শেখ (৩২) পিতা-মোঃ মজি বর রহমান শেখ, সাং-নাকাই, ৪। মোঃ রফিকুল ইসলাম @ রিপন (৪৫) পিতা-মৃতঃ লুৎফর রহমান মন্ডল, সাং-বাজুনিয়াপাড়া সকলের থানা-গোবিন্দগঞ্জ, জেলা-গাইবান্ধাদেরকে গ্রেফতার করেন।
একই সাথে তাদের নিকট থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত পিতলের মূর্তি, ভূয়া সিম ও মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।উল্লিখিত আসামীদেরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করিলে তাহারা মামলার ঘটনার সহিত জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকার করেন।গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে ও নিবিড় তদন্তে জানা যায় যে, কথিত জিনের বাদশা চক্রের সদস্যরা গভীর রাতে নির্জন জায়গায় বসে ভুক্তভোগীদের মোবাইলে কল করতে থাকে। এভাবে তারা প্রতিরাতে বিভিন্ন জেলার যেকোনো একটি মোবাইল নাম্বারকে ভিত্তি ধরে বিভিন্ন ডিজিট পরিবর্তন করে নতুন নাম্বার তৈরি করে অনবরত মোবাইলে ফোন দিতে থাকে। যে পর্যন্ত কোন এক বা দুই ব্যক্তিকে বশীভূত করতে পারে সে পর্যন্ত তারা ফোন দিতে থাকে। তারা অভিনব কৌশলে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষদের বশীভূত ও প্রলুব্ধ করেন। তারা প্রথম পর্যায়ে ভুক্তভোগীদের ফোন করে বলে,"তুমি খুব সৌভাগ্যবান, মহান সৃষ্টিকর্তা তোমার উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। তিনি তোমাকে অঢেল ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সাও স্বর্ণ প্রদান করবেন।"চক্রটি ভুক্তভোগীদের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করার জন্য তাদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, রোজা রাখা ও সৎ পথে ইসলামিক জীবন যাপন করতে বলেন। চক্রটি প্রতারণার প্রথম পর্যায়ে বশীভূত ব্যক্তিকে টোপ হিসেবে কোন মসজিদ, মাদ্রাসা বা মাজারে কোরআন শরীফ ও জায়নামাজ দেওয়ার কথা বলে বিকাশের মাধ্যমে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দাবি করেন। যে সকল ব্যক্তি প্রথম টোপটি গিলে টাকা প্রদান করে, চক্রটি তাদেরকে পর্যায়ক্রমে আরও বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন।দ্বিতীয় ধাপে, চক্রটি বশীভূত ব্যক্তিকে মাজারে মুসল্লিদের খাওয়ানোর জন্য ১ টি খাসি ও ২১ কেজি চালের দাম বিকাশে পাঠিয়ে দিতে বলে। এভাবে চক্রটি ভিকটিমদের নিকট থেকে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা গ্রহণ করে।তৃতীয় ধাপে, চক্রটি ভুক্তভোগীদের কোন নির্জন স্থান কাগজে মুড়িয়ে রেখে দিয়ে কথিত নকল স্বর্ণের পুতুল প্রদান করে। চক্রটি ভুক্তভোগীদের এই বলে শাসায় যে, পুতুলটি নিয়ে বাসায় তিন দিন পর দেখতে হবে। এর আগে দেখলে ভুক্তভোগির বিরাট ক্ষতি হবে। এমনকি দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে হঠাৎ মারা যাবেন।
এরকম ভয়ে ভীত হয়ে ভুক্তভোগীরা ঘটনাগুলো অন্যদের প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন। এ পর্যায়ে ভুক্তভোগীরা কথিত জিনের বাদশা চক্রের হাতের পুতুলে পরিণত হয়ে যান। চক্রটি তাদের যেভাবে চালায় তারা সেভাবেই পর্যায়ক্রমে অর্থ পাঠাতে থাকেন।চতুর্থ ধাপে, চক্রটি ভুক্তভোগীদের বলেন, "তোমাকে সাতটি পুরস্কার দেওয়া হবে। সাতটি বড় হাঁড়িতে স্বর্ণের মোহর পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হবে। হাঁড়িগুলো মাটির ৪১ ফুট নিচে আছে। এরমধ্যে একটি হাঁড়ির তলা খুলে গেছে। তলা মেরামতের জন্য ৩৩,৫০০/- টাকা লাগবে।" ভিকটিম তার কাছে টাকা না থাকলেও বিভিন্ন জায়গা থেকে ধার করে চক্রের নিকট ৩৩,৫০০/- পাঠায়।
পঞ্চম ধাপে, চক্রটি ভুক্তভোগী কে বলে " তোমার ঘরের চার কোণায় রক্ত দিতে হবে। এজন্য চারটি খাসি বাবদ ৪৩,৫০০/- টাকা পাঠাও।" আবারো ভুক্তভোগী চক্রের কথা মতো ধারদেনা করে ৪৩,৫০০/- টাকা পাঠিয়ে দেন।ষষ্ঠ ধাপে, চক্রটি ভুক্তভোগীকে বলে," তোমার আরো একটি সমস্যা আছে। সমস্যাটি সমাধান করার জন্য সাতটি যুবক নারী লাগবে। তুমিতো যুবক নারী সংগ্রহ করতে পারবে না। আমাদের ২৫,৫০০/- টাকা পাঠিয়ে দাও। আমরা সব ব্যবস্থা করে নিবো।" চক্রের সদস্যদের দেওয়া ফাঁদে পা দিয়ে ভুক্তভোগী আবারো বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ধারদেনা করে ২৫,৫০০/- টাকা পাঠিয়ে দেন। এভাবে চক্রটি ভুক্তভোগীকে নানা কৌশলে প্রতারিত ও প্রলুব্ধ করে পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে ১,০৮,৫০০/- টাকা হাতিয়ে নেয়।পরবর্তীতে ভুক্তভোগী আত্মীয়-স্বজন ও স্থানীয় লোকজনকে কথিত স্বর্ণের পুতুলটি দেখালে, তখন বুঝতে পারেন যে সেটি স্বর্ণের নয়। পুতুলটি পিতল বা সিমেন্ট দিয়ে তৈরি।একইভাবে এই চক্রটি এবং গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থানার তালুককানুপুর ও দরবস্ত ইউনিয়নের শত শত চক্র প্রতিনিয়ত দেশের নানা প্রান্তের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে প্রতারিত করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তাদের প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে অনেক মানুষ। বিশেষ করে নিরক্ষর, অসচেতন ও মহিলারা তাদের ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে।চক্রটি বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরদের এজেন্ট ও ডিষ্ট্রিবিউটরদের সহযোগিতায় ভুয়া সিম সংগ্রহ করে রমরমাভাবে এই প্রতারণার বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।
মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (বিকাশ, রকেট, নগদ ইত্যাদি) এ্যাজেন্টদের যোগসাজশে প্রতারকরা লক্ষ লক্ষ টাকা ক্যাশ আউট করে নিচ্ছে।ভুয়া সিম বিক্রি বা সিম জালিয়াতি বন্ধ না করলে জিনের বাদশার কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব হবে না। সিম বিক্রি কার্যক্রমকে আরো কঠোরভাবে মনিটর করে ভুয়া সিম বিক্রি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার মাধ্যমে কথিত জিনের বাদশাদের অপতৎপরতা সহ নানা ধরনের ডিজিটাল অপরাধ বন্ধ করা যেতে পারে। এ ধরনের অপরাধ বন্ধে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে গণমাধ্যমও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। গ্রেপ্তারকৃতদের আরো নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের সাথে জড়িত অন্যান্যদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।